শনিবার, ১৩ জুন, ২০০৯

শামিম ভায়ের চিঠি... এক

প্রিয় ফারুক,

তোমার ই-মেইল পেয়ে বেশ ভাল লাগল। কারন তোমার অতীতের সাথে আমারওযে একটা সংযোগ আছে। যেমন ধর বংশী নদীর কথা। তোমার মতো আমিও তাকে মিস করছি। বাংলায় তোমার সাথে ই-মেইল চালাচালি করার সুবাদে দির্ঘদিন পর বাংলায় লেখার সুযোগ হচ্ছে। তোমার সঙ্গি সাথিদের গল্প শুনে তাদের দেখতেও ইচ্ছা করছে।
তবে হয়তো ইউরোপে থাকার কারনেই হোক, ‘সময়ের প্রয়োজনে’-ই হোক আমি হয়তো তোমার চেয়ে কম আবেগপ্রবন হয়ে গেছি। এখন আমি পারত পক্ষে এখানকার বাঙ্গালীদের সাথে মিশিনা। তাদের মানসিকতার সাথে আমার মানসিকতার একটি বিস-র ব্যবধান রচিত হয়েছে। তারা ইউরোপে থাকে এতে তাদের একটি অহমিকা আছে কিন্তু নেই তার সাথে সাজুয্য পুর্ন যোগ্যতা। তারা এখনো কুয়ার ব্যাঙ্গের মতো চিন্তা করে, অর্থের মাপকাঠি দিয়ে অবাস্তকে বিচার করে। বস্তা-পচা অভ্যাস ও দেশীয় রাজনিতীর কাদাছোড়াছুড়ি থেকে তারা কোনভাবেই বের হতে চায়না। যাই হোক আমি তাদের কথা লিখে আমি আমার লেখাকে লম্বা করতে চাচ্ছিনা।

আমি চেষ্টা করছি পশ্চিমা বা বিশ্ব সভ্যতাকে নিজের মতো করে বুঝতে। তাদের ভালো দিকগুলিকে নিজের মধ্যে ধারন করতে ও আমার ভালোদিকগুলি দিয়ে তাদের প্রভাবিত করতে।
যেমন ধর: স্টেলিওসের কথা, সে একজন গ্রিক বয়স ৩০ বেলজিয়ামে প্রোগ্রামার হিসাবে নামকরা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। খুব মোটা অংকের স্যালারী ড্র করে। তার সাথে আমার প্রতি সপ্তাহে একবার কাছের একটি ফাষ্ট ফুডে আড্ডা হয়। সে অত্যন- যুক্তিবাদি কিন্তু সে ধর্ম, পরকাল বা খোদায় বিশ্বাস করেনা। তার সাথে এ নিয়ে প্রচুর তর্ক হয়। কিন্তু সেটি সমঝোতাপূর্ন পরিবেশে। সে আমাকে আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনার বিষয়ে সাহায্য করে ও উতসাহ দেয়।
মিশেল : একজন বেলজ। বয়স ৩৫। সে ক্যাথলিক থেকে ইসলাম গ্রহন করেছে। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলোসোফির ছাত্র থাকা কালে ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহ হয়। কিন্তু তার প্রফেসররা তার প্রশ্নের সদুত্তর না দিতে পারায় সে নিজেই এ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে এবং ইসলাম তার এতই ভালো লাগে যে সে মুসলিম হয়ে যায়। সে এখন একটি হাইস্কুলের শিক্ষক। সে তোমার আমার মতো সাধারন মুসলিমের চেয়ে ইসলাম সম্পর্কে অনেক বেশী জানে। মাঝে মাঝে তার সাথে আমার ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা হয়। । মজার ব্যাপার হলো সে অনেকদিন আগে একবার বাংলাদেশেও গিয়েছিল। বাংলাদেশের মেয়েদের তার ভিষন পছন্দ হয়ে ছিল। তাই সে একটি বাংলাদেশি মেয়েকে বিয়েও করতে চেয়েছিল। এমনকি আমার ছোট বোনের ব্যাপারে একটু কথাও হয়েছির কিন্তু আমার বাসা থেকে রাজি না হওয়াতে বিষয়টি আর বেশীদুর গড়ায়নি। সে এখন একজন মরোক্কান মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করেছে। তার বিয়ের পর আর তার বাসায় যাওয়া হয়নি তবে সে আমার কাজের যায়গাতে মাঝে মাঝে আসে। দির্ঘদিন যোগাযোগ না থাকলে সে আমাকে ফোন করে।
ভার্জিনী : একজন রুয়ান্ডান তবে বর্তমানে বেলজ নাগিরকত্ব পেয়েছে। বয়স ৩০-৩২। রুয়ান্ডার গৃহযুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষ তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। সে একমাত্র পালিয়ে প্রথমে ফ্রান্সে ও পরে বেলজিয়ামে চলে আসে। সে ট্রান্সলেশনের উপর গ্রাজুয়েশন করেছে এবং কাজের সন্ধান করছে। সে তার সুবিধাজনক সময়ে সপ্তাহে একবার কি দুবার আমাকে ফোন করে তার বাসায় যেতে বলে। সে আমাকে ফেঞ্চ শিখার ব্যাপারে সাহায্য করছে এবং আমরা মাঝে মাঝে রুয়ান্ডা ও বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করি।
ইসাবেল : একজন ডাচভাষি বেলজ। বয়স ৩০। আমি আগে যেখানে কাজ করতাম তার পাশেই থাকতো সেই সুবাদেই পরিচয়। তখন তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ হত। বর্তমানে সে ইংল্যান্ডে একটি নামকরা কম্পানীতে কাজ করে এবং সেখানেই থাকে। তবে মাসে একবার দুবার বেলজিয়ামে তার পরিবারের কাছে আসলে মাঝে মধ্যে আমার সাথে দেখা করে। তাছাড়া ইমেইলের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। তার ইসলাম সম্পর্কে ভিষন আগ্রহ আমি তাকে ইসলাম সম্পর্কে বলি আর সে আমাকে ডাচ ভাষা শিখার ব্যাপারে সাহয্য করে। আমার ক্যারিয়ার ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার ব্যাপারে সে ভিষন আগ্রহী।
আসলান : যদিও সত্যিকারে একজন তুর্কি কিন্তু নেদারল্যান্ডের নাগরিকত্বধারি ও সেখানেই বিয়ে করেছে। বয়স ৩৫/৩৬। বেলজিয়ামে একটি উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছে পাশাপাশি একটি সুপারমার্কেটে কাজ করছে। মুসলিম ও ভিষন আবেগ প্রবন কিন্তু সে তার সাথে শুধু ডাচ ভাষাতেই কমিউনিকেশন করতে হয় বলে আবেগ খুব বেশি শেয়ার করতে পারিনা। প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহেই তার সাথে কফি খেতে খেতে আড্ডা হয়। সে আমার ডাচ নিয়ে ঠাট্টা করে আর আমি তার ইংরেজি নিয়ে। সে আমার পরস্পরে পড়াশোনা, ইসলাম ও ক্যারিয়ার নিয়ে একে অন্যেকে উতসাহ দেই।
পেরে : একজন স্প্যানিশ। বয়স ৩৫। ভার্জিনীর প্রতিবেশী। যদিও সে একজন ফরেস্ট ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু কাজ করছে একটি ৪ তারা হোটেলে। তার সাথে বেশিদিনে পরিচয় নয় তারপরও তার পারসোনালিটি আমার খুবভালো লাগে। একজন ক্যাথলিক হয়েউ ইসলাম ও জিবন সম্পর্কে তার উদার ধারনা আমাকে ভিষন ভাবে নাড়া দেয়। তার সাথে আমার কথা হয় ভাঙ্গা ভাঙ্গা ফ্রেঞ্চে কখোনো সখোনো ইংরেজিতে। ইদানিং আমি তার কাছে স্প্যানিশ শিখার আগ্রহ প্রকাশ করেছি।
মুহাম্মদ : যদিও এটি তার নতুন নাম। ইসলাম গ্রহন করার পর সে এই নাম গ্রহন করেছে যদিও তার পরিবার এবং সন্তান সন্ততি এখোনো ইসলাম গ্রহন করেনি। বয়স ৪৫। সে ভারতীয় মহাসাগরের একটি দ্বীপ, মাদাগাস্কারের অধিবাসি। বেলজিয়ামে ডিপ্লোম্যাট হিসাবে আগমন কিন্তু তার নতুন সরকারের সাথে রাজনৈতির মতোবিরোধিতার কারনে সে তার দেশে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক এবং এখানেই থেকে যাবার চেষ্টা করছে। সে জানতে পেরেছে যে তার পুর্বপূরুষ ছিল মুসলিম এবং ভারতীয় তাই সে ইসলাম ও ভারতিয় ব্যাপারে অনুসন্ধান করছে এবং একারনেই তার সাথে আমার সখ্যতা। সে নিজে একজন কালোমানুষ কিন্তু তার স্ত্রী ফ্রেঞ্চ বংশোদ্ভুত সাদা মহিলা। কিন্তু মহিলা কালোমানুষ সম্পর্কে তার ভিষন মায়া। তার পরিবারটি একটি চমতকার পরিবার। শহর থেকে দুরে মফস্বলে সে থাকে। সে শহরে আসলে তার সাথে আমার কথা-বার্তা হয়। একবার তার বাসায় গিয়েছিলাম। তার আতিথেয়তায় আমি অভিভুত যদিও আমার বাসায় তাকে এখোনো আনতে পারিনি।
যাই হোক অনেক বেশী লম্বা হয়ে যাবার কারনে আমি শেষ করছি। আমার এতো কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, বালাদেশে জম্ন হয়েছে বলে সবমসময় বাঙ্গালীদের সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে হবে তা নয়। যদি তোমার সুযোগ ও পরিবেশ থাকে তবে বিশ্ব সভ্যতার সাথে সংযোগ সংস্থাপন করো। নিজের অভিজ্ঞতাকে অন্যদের সাথে মিলিয়ে নাও। বিশ্বকে আপন করতে না পারলে কুয়ার ব্যাঙ্গ হিসাবেই জন্ম ও মৃতূ হবে, স্রষ্টার সৃষ্টি সোনালী সুর্য, নীল সমুদ্র ও সবুজ ভুমি তোমার কাছে নিরর্থকই রয়ে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন