স্মৃতিগুলোই রয়ে যায় অবশিষ্ট। দুবাইয়ের মরুময় আবহাওয়ায় নিজেকে আজো খাপ খাইয়ে নিতে পারলামনা। যে আশা আকাঙ্খা নিয়ে আসা তার বিন্দু মাত্রও পূরণ করতে পারলামনা। দুইটি বছর পার হয়ে গেলো। এই প্রবাস জীবনে অনেকের সহচার্য পেলাম। অনেক না জানা, না দেখা অভিজ্ঞতা হলো। অনেক পুরোনো মুখ ফেলে এসে অনেক নতুন মুখের সন্ধান পেলাম এই দুবাইতে। অনেকের মধ্যে একটি নাম অনেকদিন মনে থাকার কথা। যদিও মানুষ কাউকে চিরদিন বেঁধে রাখতে পারেনা। একদিন তাকে বিদায় দিতেই হয়। অনেক আদরের জিনিসটিকেও ছেড়ে দিতে হয় নীদাবী করে। এটাই মানুষের বড় ব্যর্থতা। এখানেই পরাজয় ঘটে উশৃঙ্খলার ।
মনে পড়ে গভীর ভাবে শ্রষ্ঠার অপার ভাবনার কথা, তাঁর পরিচালনার কথা। গেয়ে ওঠি এই গান শ্রষ্ঠার পানে, খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে....
বন্ধুত্বকে আমি একটু ভিন্ন চোখে দেখি, যা আর দশজন থেকে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম। এতে তাই একটু আপত্তি বা দুকথা ওঠতেই পারে কিংবা কারো কারো চোখে বেমানসই লাগতেই পারে। সেটা হলো সকল ব্যবধানের দেয়াল টুটা। আমার ভাবনায় বন্ধুত্ব মানে না থাকবে ব্যবধান গরিব-ধনীর, না থাকবে পার্থক্য ৮০ বছর আর ৮ বছরের শিশুর, থাকবেনা ব্যবধান সাদা-কালোর, থাকবেনা ব্যবধান দেশ-বিদেশের। এই হলো আমার বন্ধুত্ব। যদি সুন্দর মনের মানুষের সংঘ পাই, যদি এই ব্যবধানগুলো না মানার একটি সংস্কারশীল মন পাই তার সাথেই আমি বন্ধুত্ব গড়ি। তার কাছে বলতে ভয় পাইনা অনেক আন-রিক কথা। অনেক এমন কথা আর অভিজ্ঞতা যা হৃদয় স্পর্শ করে। পৃথিবীর অনেক মানুষের ভিড়ে এমন অনেক বন্ধু আমি পেয়েছি যারা আমার মনের চিন্তা- চেতনায় মিলেছিলো অনেকাংশে।
দুবাইতে এসে এমন একজনকে পেয়েছিলাম হঠাত করে। পরিচয় হওয়ার অনেকদিন আগে থেকেই দেখতে ছিলাম ওকে। একদিন কথা বলবো বলে অনেক সময় কাটিয়েছি। প্রায় প্রতিদিনই দেখা হতো, হতো না কথা। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতাম। ঠিক ও-ও মনে হয় কি যেনো বলবে বলে বুঝা যেতো। কিন্তু এগিয়ে আসা হয়নি অনেকদিন।
একদিন হঠাত করে বলে ফেললাম -- আপনার নাম কি? উত্তর পেলাম- শাকিল। এরপর জিজ্ঞেস করলমার কোথায় বাড়ি, কোথায় কাজ করা হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা। ভেঙ্গে গেলো কথা না বলার প্ররম্ভিক ইতস্ততা।
এরপর থেকে শুরু হলো একে একে অনেক কথা। আমাদের হোটেলে মেইনেনেন্স কাজের ভার নিয়েছিলো শাকিলদের মালিক। কাজের গতি এবং শ্রমিকদের তদারকি করা এবং মাঝে মাঝে সাহায্য করতে শাকিল সপ্তাহে প্রায় ৪/৫ দিন আসতো। প্রায় ২/৩ মাস ধরে কাজ চলতে থাকে।
ইতিমধ্যে রমজান এসে গেলো। ওরা নিয়মিত রোজা রাখতো। ইফতারের সময় হলে আমরা সবাই মিলে ইফতার করতে ক্যাফেটেরিয়ায় বসতাম। আন্তরিকতা আরো বাড়তে লাগলো। রোজা শেষ হয়ে গেলো। এরপর পর ওদের কাজও শেষ হয়ে গেলো।
শাকিল চলে এলো আগের যায়গায় অর্থাত অফিসে। মূলত শাকিল অফিসিয়াল কাজের দায়িত্বেই নিয়জিত ছিলো। ওদের অফিসটা দেরাতে। আল্ মাখতুম হাসপাতালের সামনের রাস্তায় কিছুটা ভেতরে গিয়ে হাতের ডানপাশে অবস্থিত শাকিলদের অফিসটা।
প্রতিদিন ফোনে কথা হয়। সুবিধা ছিলো এখানে লোকাল কলের কোনো বিল হয়না। এর সুবিধা নিয়ে দিনের অনেক সময় যখনই সময় পেতাম আলাপচারিতায় বসে যেতাম।
কী আলাপ হতো, পারিবারিক, প্রবাসের ভাল লাগা- না লাগা, স্বদেশের কথা, দেশীয় রাজনৈতিক কথা, নিত্যদিনের চলমান ঘটনার ধারাভাষ্য ইত্যাদি নানা কথা হতো সারা দিন ধরে। আমাদের ভিলাতেই লেন্ড লাইনছিল। কিচেনের পাশেই টেলিফোন সেট। রান্না করতে এসে মনির কিংবা জামাল ওদেরকে রান্না করতে দিয়ে টেলিফোনের বোতামে টিপ দিয়ে কানেক্ট হতাম শাকিলের সাথে।
ওরা গত জানুয়ারী থেকে ইন্টারনেটে টেলিফোন সার্ভিস চালু করে। প্রতি মিনিট ১ দিরহাম। সস্তায় দেশে ফোন করার সুবিধা ভোগ করার জন্য অনেকে ভিড় জমায় ওদের অফিসে। মোটামুটি ব্যবসা চলতে থাকে।
কিন্তু শাকিলের ওপর চেপে যায় লম্বা ডিউটি। সকাল ৯/১০ থেকে রাত ১২/১ টা পর্যন- খোলা রাখতে হয় অফিস। এই দীর্ঘ সময়টা কাটানো শাকিলের জন্য বেশ বিতৃষ্ণার ব্যাপার হয়ে পড়ে। তাই ফোনে আলাপচারিতা জমে ওঠে আরো বেশ ভাল করে। চলতে থাকে আলাপচারিতা।
জীবন বড্ড গতিময়, জীবনের তাগিদে বিদায়ের ডাক এসে যায় দুজনেরই। আমি দুবাই গ্র্যান্ডে হোটেল ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার ব্যাবস্থা করলাম। আর শাকিলের ফোন এলো দেশ থেকে, ওকে জরুরী ভাবে যেতে হবে বাড়িতে। আর এভাবেই যবনিকা টানতে হলো ক্ষনকালীন পরিচয়ের।
ফারুক-২৮/০৩/০৬
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন